পুনর্বিন্যাস

মৌটুসি ঘোষদেসরকার

সকালটা ভারি সুন্দর ছিল। ফুরফুরে হাওয়া, হালকা মিঠে রোদ। হাতে কাগজ, পাশের টেবিলে চায়ের কাপ। হঠাৎ  এক শালিক বাবাজি এসে ডাকাডাকি শুরু করল। সবাই জানে শালিকের ডাক মোটেও শ্রুতিমধুর নয। একটু হুট হুট করলাম, তাতে কাজ হল, সে চলে গেল। চাযে চুমুক দিয়ে দেখি তিনি জুরন্তি নগরে গেছেন। মিতালি মিতালি বলে হাঁকা হাঁকি শুরু করলাম, উত্তর এল না। আলসেমি করে উঠলাম না, কাগজে মননিবেশ করলাম। একটু পরে দেখি নিজে থেকেই গরম ধুমায়িত চা এসে হাজির,হাসি মুখে ঠান্ডা চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিলাম পচার মাকে।

এহেন স্বর্গ সুখের মাঝে আবার শালিক, এবার জোড়ে। তা বসবি বস, না! আবার ডাকাডাকি। একে একে জড়ো হতে লাগলো শালিক রা। এক সময়ে আমার বারান্দার রেলিং টা আর দেখা গেল না।

মনেমনে ভাবলাম উঠে দাঁড়াই, কাগজটা মন দিয়ে পড়তে পারছি না। একবার শালিক সমুহর দিকে তাকাই একবার কাগজের পাতায়, এই করে খানিকটা সময গেল, চা শেষ হল। অনেক বিবেচনার পর চেয়ার থেকে উঠলাম, আর যেই না ওঠা  অম্নি সবকটা শালিক এক সাথে আমার দিকে লাফিয়ে পড়লো বারান্দার রেলিং থেকে। সহজাত প্রবৃত্তিতে চোখ বন্ধ করলাম।

চোখ খুলে দেখি একটা অন্ধকার গুহার মধ্যে পড়ে আছি। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম একটু দূরে্ একটা আলো দেখা যাচ্ছে। সেইদিকেই চললাম। খানিক হাঁটার পর আলোটার কাছাকাছি চলে এলাম। আর একটু এগোতেই গুহা থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুটা খালি জায়গা। তাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক গাছ, বেশ মোটাসোটা এবং আকাশ ছোঁয়া। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি তার রঙ সবুজ। এতক্ষন অন্ধকারে থেকে গুহার বাইরে টা খুব উজ্জ্বল মনে হচ্ছিলো। চোখ সইতে একটু সময় লাগলো।

এক পা দু পা করে এগোতে লাগলাম। হঠাৎ  দেখি একটা বিশাল পাখির পা। আস্তে আস্তে মাথা উঁচু করতে থাকলাম, পা টা অনেক দূরে গিয়ে যেন মেঘের মধ্যে হারিয়ে গেলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কি যেন খপ করে আমাকে তুলে বেশ উঁচু একটা গাছের ডালে বসিয়ে দিলো। এবার দেখলাম পা টা মেঘে না এক বিশালাকার পাখির গায়ের মধ্যে হারিয়ে গেছিলো।

“মহাশয় আপনাকে এ ভাবে ধরে আনার জন্য দুঃখিত কিন্তু আমাদের শালিক আন্তর্জাল সূত্রে খবর আছে যে আপনার সাহায্যের প্রয়োজন, যখনি যার সাহায্যের প্রয়োজন হয় আমরা তাকেখুব   উত্সাহ সহকারে সাহায্য করে থাকি। তবে কিনা এই সমান্তরাল পৃথিবী তে নিয়ে আসতে হয়ে তাকে।“ এই অবধি বলে বিশাল পাখি থামল।

আমার তো সব জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পেয়েছে ততোক্ষণে। ভ্যাবলাকান্তের মতন তাকিয়ে আছি বিশাল পাখির দিকে। পাখি আমার মনের কথা বুঝতে পারল মনে হয় তাই আবার বলতে শুরু করলো। সে গলা ভারি মনোরম।

“মহাশয় আপনি যেই পৃথিবী তে থাকেন সেখানে মানুষ হল এপেক্স বা সর্বোচ্চ স্থানে, বুদ্ধি  দিয়ে সে এই স্থান গ্রহন করেছে, বাকি সব প্রাণীদের নিজের অধীনে করেছে  এই পৃথিবী তে আমরা শলিকেরা সর্বোচ্চ স্থান অধিগ্রহণ করেছি। একের পর এক সমান্তরাল পৃথিবী আছে, কতগুলো আমি জানি না, তবে আমি বেশ কয়েকটিতে বিচরণ করেছি। প্রত্যেকটি অনন্য।“

“আসুন আপনাকে এই পৃথিবী যার নাম ‘জিউমা’ তার কিছুটা পরিভ্রমণ করাই।“ এই বলে সেই বিশালাকার পাখিটি আমাকে তার সাথে হাঁটতে বলল, কিছুদুর গিয়ে ডালটা শেষ হয়ে গেছে তাই একটু অবাক হয়ে তাকালাম। পাখি বলল,  “ভয় নেই আপনি যত এগোতে চাইবেন ডাল তত এগোতে থাকবে। বুরুচ এক বিশেষ গাছ যেদিকে যেভাবে চায় নিজেকে সম্প্রসারিত করতে পারে।“

বেশ খানিকটা যাওয়ার পর সমতল ভুমি ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করলো। যেদিকে তাকাই শুধু বিশালাকার বৃক্ষসমূহ। সে সব বৃক্ষের মাথা দেখা যায়না কোনটা ফলের কোনটা ফুলের তবে তাদের রঙ গন্ধ আকার কিছুই আমার চেনা কোন ফুল বা ফলের সঙ্গে মিলছে না।

একটু দূরে একটা সবুজ চকচকে নদীর আকৃতি দেখতে পেলাম। পাখিটি যেন আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল,”জিউমার নদী, আকাশ সব আপনাদের পৃথিবীর মতন, শুধু একরকম বেগুনি।“ আমি বললাম,”বেগুনি কোথায় আমি ত দেখছি সবুজ।“ পাখি মাথা নাডল, “আপনি আমাদের পৃথিবীর রঙ দেখতে পাবেন না কারন আপনার চোখ সেই রঙ গ্রহণ করতে পারবে না।“

এবার চোখে পড়ল নদীর ধার ঘেষে কিছু ডোম আকারের স্থাপত্য, জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকাতে পাখি বলল, “ওটা একটা বসতি।“ আমি বললাম, “ওখানে আপনার বাড়ি?” পাখি মাথা নেডে বলল, “না, আমার বাড়ি এখান থেকে অনেক দুরে। পরের বার এলে নিয়ে যাবো। ওখানে থাকে এই পৃথিবীর কিছু বাসিন্দা যারা জলকে জয় করেছে।“ আমি হাঁ করে তাকিয়ে  থাকলাম ।

পাখি গল্প শুরু করল, “জিউমা তে অনেক রকম প্রাণী বাস করে, কেউ জলে কে জয় করেছে, কেউ বা স্থল কে আবার কেউ বা আমাদের মতন আকাশ এবং বায়ু কে। কিছু এমন প্রাণীও আছে যারা নিদ্রা, আহার এমনকি মৃত্যু কেও জয় করেছে। একবারে তো দেখা হবে না সবার সাথে, তবে আপনার লেখার জন্য আজ যা দেখছেন তাই যথেষ্ট।“

“লেখা? আমি তো লিখি না।“ খানিকটা অবাক হয়ে পাখির দিকে তাকালাম। পাখি কিছু বলল না। বুরুছ আর পাখির সাথে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে এক সময়ে আবার সেই গুহা টার কাছে ফিরে এলাম। পাখি বলল, “এবার আপনি  আপনার পৃথিবীতে ফিরে যান, মনে হয় আপনার সাহায্য করতে পেরেছি।“ বুঝলাম প্রশ্ন করলে উত্তর পাব না, তাই গুটি গুটি পায়ে গুহায় ঢুকলাম, ভেতরটা অন্ধকার,অনেকদূর অব্দি  দেখা যায় না, তবু চললাম, একসময়ে খুব ক্লান্ত লাগলো, বসে পড়লাম, চোখ বুজলাম।

“কিগো কি হোল? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্চো নাকি? কখন থেকে সাড়া নেই কেন?, কতবার ডাকলাম।“ মিতালির কথায় যেন চমক ভাঙল। আশে পাশে তাকিয়ে দেখি আমি আমার বারান্দায় দাড়িয়ে আছি।

অভিজ্ঞতাটা চটপট লিখে ফেললাম, হপ্তা খানেকের মধ্যে সেটা বেশ একটা উপভোগ্য রূপ নিল। কাকতালীয় ব্যাপার মশাই আমার এক খুড়তুতো বোন অনু কিছুদিন হল একটি পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেছে, একদিন বাড়িতে এলো, এ কথা সে কথার পর হঠাত্ বলে, “দাদা তুই তো ভাল লিখতিস, আবার লেখ না, অন্য কাজ তো নেই এখন, আগে নাহয় অনেক অজুহাত দেখাতিস।“

কি খেয়ালে চট করে লেখা টা দিলাম আনুকে। মাসখানেকের মধ্যে লেখাটা ছাপা হল, পাঠক পাঠিকাদের মনঃপুত হল, এবং আমি ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হলাম। লেখা শুরু করলাম, প্রথমে ছোটো ছোটো রচনা, তারপর বড় গল্প – উপনাাস। এই ভাবেই আমার নতুন জীবন বা যাকে বলে সেকেন্ড ইনিংস  শুরু হল। যারা আমাকে সাহায্য করল নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেতে তাদের পৃথিবীতে আর যাওয়া হয়নি। আসলে সেই ভাবে চা এর পেয়ালা নিয়ে বসে অলস সকাল বহুদিন কাটানো হয়নি। সৃষ্টির আনন্দে মেতে আছি, যেন আমার পুনর্বিন্যাস হয়েছে।

1 thought on “পুনর্বিন্যাস

  1. amritawrites – India – Words are a beautiful way to express our innermost thoughts. I am a thinker and would like to use the power of words to share my thoughts, make friends and bring the world closer. To help me fulfill my dreams I need to earn and the only way I can keep both my passion and my bank account going is to do the one thing I love the most - to write. So there I am a Freelance writer. I write about almost everything and above all travel. Let me know if I can use my writing skills to help how you out in any way. Drop me an email at amchat7377@gmail.com and I will definitely get back to you.
    amritawrites on said:

    Nice read!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *